সারা পৃথিবীর মতো পশ্চিমবঙ্গও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশেগুলোতেও এই বেড়ে যাওয়ার পরিমাণ অনেক বেশী। দরকারের চেয়ে অতিরিক্ত খাওয়া, ব্যায়াম না করা এবং বংশগত কারণেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কারো একবার ডায়াবেটিস দেখা দিলে তা আর ভাল হওয়া সম্ভব না, তবে যা সম্ভব তা হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে হার্টের রোগ, স্ট্রোক, চোখ ও কিডনির সমস্যা এড়ানো সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কি, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ যা শরীরের যে কোনো অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিতে পারে। আর এ কারণেই যে কোনো রোগ দেখা দিলে আমরা ডায়াবেটিস পরীক্ষা করি।
নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা
যাদের পক্ষে সম্ভব তারা অবশ্যই গ্লুকোমিটার কিনে নিবেন। প্রতিদিন সম্ভব না হলে সপ্তাহে একদিন অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ নিজের মেশিনে চেক করে নিবেন। রক্তের এই পরীক্ষা দিনের বিভিন্ন সময়ে (খালি পেটে, নাস্তার ২ ঘন্টা পর, দুপুরের খাওয়ার আগে ও পরে, রাতে খাওয়ার আগে ও পরে) করতে হবে। খাবার (খাদ্য তালিকা অনুযায়ী) অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে এবং অল্প করে ৩ ঘন্টা পর পর খেতে হবে। (৮টা, ১১টা, ২টা, ৫টা, ৯টা এবং রাতে শোয়ার আগে অবশ্যই কিছু খেয়ে শোবেন)। নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং ওষুধ খাওয়ার পরও যদি একজন রোগীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশী থাকে অথবা (HBA1c) ৭% এর বেশী থাকে তবে বুঝতে হবে শরীরে ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দরকারে ইনসুলিন শুরু করতে হবে।
নতুন অবস্থায় অথবা হঠাৎ করে রক্তের গ্লুকোজ কোনো কারণে বেড়ে গেলে ইনসুলিন নিয়ে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে হবে। ইনসুলিন নিতে প্রত্যেক রোগীই ভয় পায়। শরীর ভাল রাখতে হলে ইনসুলিন নিয়েই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শরীর ভাল থাকলে, মন ভাল থাকে, কাজ কর্মে দক্ষতা বাড়ে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটবেন। এমনভাবে হাটতে হবে যাতে আপনার (Pulse) বাড়ে। হাঁটা শুরুর আগে ৫-১০ মিনিট শরীর গরম (Worm-up) করে নেবেন এবং ৩০ মিনিট জোরে হাঁটার পর আবার ধীরে ধীরে হেঁটে শরীর ঠান্ডা (Cool-down) করে নেবেন। হাঁটতে যাওয়ার আগে জল খেয়ে নেবেন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
ডায়াবেটিস রোগীরা অবশ্যই নিয়মিত কিডনি, রক্তের চর্বি এবং হৃদরোগের পরীক্ষাগুলো করবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা প্রতি ৬ মাস পর পর চোখ (Fundoscopy) পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাবেন। মনে রাখবেন, একজন চিকিৎসক একা কখনো গ্লুকোজ এবং ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। যদি রোগীরা সাহায্য না করে।
গর্ভাবস্থায়
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ধরা পড়লে অবশ্যই ইনসুলিন নিতে হবে এবং আরও কঠিন ভাবে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। (F, 2 hours ABF, 2 hours AL, 2 hours AD) ৬ মিলিমোল/লি: এর নিচে এবং গড় (A1c) ৬.৫% এর নিচে। মহিলা ডায়াবেটিস রোগীরা বাচ্চা নেওয়ার আগেই ইনসুলিন নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে নেবেন।
পায়ের যত্ন
পা মানব দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ডায়াবেটিস রোগের কারণে পায়ে নানা প্রকার অসুবিধা দেখা দিতে পারে। স্নায়ুতন্ত্রের অকার্যকারিতা ও রক্ত সরবরাহের অসুবিধার কারণে পায়ের অনুভূতিশক্তি কমে যায় এবং পায়ে আঘাত লেগে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এর ফলে পায়ে পচনশীল ঘাঁ হতে পারে, ফলে পা কেটে ফেলতে হয়। সকল ডায়াবেটিস রোগীকে তাই পায়ের বিশেষ যত্ন নিতে হয়।
পায়ের অসুবিধা এড়াতে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত
১) খালি পায়ে হাঁটবেন না। নরম ও আরাম লাগে এমন জুতো পরে হাঁটবেন। মোজা না পরে কখনোই খালি পায়ে জুতো পরবেন না।
২) পায়ে অত্যধিক গরম জল ঢালবেন না।
৩) পায়ে যেন কোনো আঘাত না লাগে এবং ক্ষত না হয়। পায়ের রঙের কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
৪) নিয়মিত পায়ের বাড়তি নখ কাটবেন, নখ কাটার সময় বিশেষভাবে সাবধানতা অবলম্বন করবেন, যাতে আঙ্গুলে আঘাত না লাগে।
৫) পায়ের কড়া নিজে কাটবেন না। ময়লা বা ভিজে মোজা পরবেন না।
৬) রক্ত চলাচলের জন্য রোজ নিয়মিত পায়ের ব্যায়াম করবেন।
৭) প্রতিদিন ভালভাবে পা ধুয়ে শুকনা কাপড় দিয়ে পা মুছে ফেলবেন। পায়ের দুই আঙ্গুলের মাঝের জায়গা যেন ভিজে না থাকে।
৮) ভালোভাবে দেখার জন্য আয়না ব্যবহার করতে পারেন বা অন্যের সাহায্য নিতে পারেন।
অসুখ হলে
যে কোনো অসুস্থতায় যেমন জ্বর, বমি, পাতলা পায়খানা এবং শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে গেলে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজ ও রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে। দরকার হলে ইনসুলিনের ডোজ বাড়াতে বা কমাতে হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইনসুলিন বন্ধ করলে যেমন সমস্যা হতে পারে আবার ডোজ বেশী হলে রক্তের গ্লুকোজ কমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। রক্তের গ্লুকোজ (৪ মিলি মোল) কমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কিছু খেয়ে নিতে হবে, খেতে না পারলে গ্লুকোজ শিরায় নিতে হবে।
সতর্কতা
রাস্তা ঘাটে লোকজনের অযাচিত উপদেশ ও পত্রিকার সস্তা চিকিৎসার প্ররোচনায় হঠাৎ করে ইনসুলিন বন্ধ করবেন না। সে ক্ষেত্রে DKA অথবা HONK এর মতো জটিলতা হতে পারে এবং আপনাকে খুব দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পারে। অযথা ব্যথার ওষুধ খাবেন না। কারণ এতে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ে অযথা ভয় পাবেন না অথবা ডায়াবেটিসকে অবহেলা করবেন না। অবহেলা করার জন্য ডায়াবেটিসের যেসব জটিলতা দেখা দেয় তা যেমন ব্যয়বহুল এবং একই সঙ্গে এর চিকিৎসা হতাশাব্যঞ্জক।
ডায়াবেটিস রোগী হিসাবে আপনার নিজের দায়িত্ব (গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ) সম্পর্কে সচেতন হন, পরিবার পরিজনকে সচেতন করে তোলেন এবং শারীরিক পরিশ্রম করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন।
আসুন, আমরা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক পরিশ্রম করি এবং প্রথম অবস্থা